Translate

শুক্রবার, ২৯ জুন, ২০১২

শিশুরাও আক্রান্ত, মাসে ৩ কোটি টাকার পর্নো ডাউনলোড

ঢাকা: দনিয়ার এ.কে স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রিয়াজ উদ্দিন (১৩)। ক’দিন আগে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে কিছু একটা লুকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ধরা পড়ে যায় মায়ের হাতে।

লুকানো জিনিসটি আর কিছু না, ছোট একটা মেমোরী কার্ড এবং একটা কার্ড রিডার। কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে ভয়ংকর রুচি বিবর্জিত বেশ কিছু ভিডিও দৃশ্য এবং স্থির চিত্র। এক রিয়াজ উদ্দিনই নয়, এ রকম আরো অনেক শিশু, কিশোর, যুবক আক্রান্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফির ভয়ংকর থাবায়।

তারা বিভিন্ন সাইবার ক্যাফেতে অশালীন ভিডিও দেখে। অনেকে মেমোরি কার্ডে তা ডাউনলোড করে নিয়ে নেয়। পরে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে মোবাইল ফোনে দেখে। এক্ষেত্রে তারা কার্ড রিডার ব্যবহার করে।

অনেকে আবার ইন্টারনেট সুবিধা সম্বলিত মোবাইল সেট ব্যবহার করে সরাসরি পর্নো সাইটগুলোতে প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডাউনলোড করে তা বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঘরের কম্পিউটারে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব দেখছে ও ডাউনলোড করে নেয় অনেকে।

এ বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে রিয়াজউদ্দিনের বাবা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা যত দিনে জানতে পেরেছি তত দিনে সে খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে বেশ মিশতে শুরু করেছে। এ টুকুন ছেলে কিছু বুঝতে শেখার আগেই এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে ভাবলে গা শিউরে উঠে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, ‘কিছু দিন আগে এ বিষয়ে একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে শুধু ঢাকাতেই শহরের বিভিন্ন সাইবার ক্যাফে থেকে প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকার পর্নোগ্র্যাফি ডাউনলোড করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শিশু, কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা। যাদের বড় একটা অংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী।’

তিনি বলেন, ‘ফার্মগেট, গুলিস্তান, নীলক্ষেত, ধানমন্ডির সাতমসজিদ, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ, শ্যামলী, গুলশানসহ বেশ কয়েকটি জোনে এ ডাউনলোড সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আক্রান্তদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।

ধনী পরিবারের ছেলেরা বেশির ভাগ নিজেদের ঘরে বসে কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে এসব করছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একদিকে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, অন্যদিকে পিছনে বসে মোবাইলে এসব দেখছে ছাত্ররা।’ 

রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ীর কয়েকটি সাইবার ক্যাফেতে ব্যবহৃত কম্পিউটারের ব্রাউজিং লিস্ট (বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশের তালিকা) থেকে দেখা যায়, সাইবার ক্যাফেতে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাদের ৯৫-৯৭ শতাংশের বেশি পর্নো সাইটগুলো ব্রাউজ করেন।

সাইবার ক্যাফেতে বসে পর্নোসাইটে প্রবেশের প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ এখানকার কম্পিউটারগুলো ছোট ছোট খুপরির মধ্যে বসানো। কম্পিউটার বুথে দরজা লাগিয়ে কিংবা দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বিশেষ কৌশলে এ খুপরিগুলো তৈরি করা হয়। বিকৃত মানসিকতা এবং অতিমুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে এ ধরণের খুপরি তৈরি করে রেখেছে ক্যাফে মালিকরা।

ব্যাঙের ছাতার মত শহরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে এসব সাইবার ক্যাফে। সাইবার ক্যাফে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সূত্রে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে আনুমানিক ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ সাইবার ক্যাফে রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবের বাইরেও বিভিন্ন কম্পিউটার দোকানসহ অসংখ্য সাইবার ক্যাফে গড়ে উঠেছে।

সাইবার ক্যাফের ডিজাইন সর্ম্পকে সাইবার ক্যাফে ওর্নাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক এ. এম কামাল উদ্দিন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সাইবার ক্যাফে নির্মাণের ক্ষেত্রে কম্পিউটার বুথের দেওয়ালে উচ্চতা ৪ ফিটের বেশি হতে পারবে না। এটি খোলা দরজার এবং খোলা মেলা হতে হবে।’

ছোট ছোট স্কুল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষরা আক্রান্ত হচ্ছেন এই ভয়ংকর ব্যাধিতে। জড়িয়ে পড়ছেন নানা ধরণের অপরাধে।

অধ্যাপক আমানুল্লাহ বলেন, ‘পর্নোগ্রাফিতে আক্রান্তদের সাইকোলজি কোমায় (মানসিকতার চুড়ান্ত বিকৃতি) চলে যায়। এই পর্নোগ্রাফিতে মানসিক অসুস্থতা শুরু হয়ে এটি ব্যক্তিত্বের মধ্যে অসুস্থতা সৃষ্টি করে। ফলে আক্রান্তরা স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মিশতে পারে না, তাড়াতাড়ি লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, কমবয়সে বিয়ে করে ফেলে।’

তিনি বলেন, ‘গত কয়েক মাসে যেসব খুনের ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে অল্প বয়সীরা জড়িত। তাদের এ অপরাধ প্রবণতার পেছনের কারণ খুঁজলে দেখা যায়, তারা কোন না কোনভাবে পর্নোগ্রাফিতে আক্রান্ত। দেখা যায়, বিকৃত মানসিকতার কারণে এরা খুন, ধর্ষণ, লাশ টুকরা করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের বিকৃত অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

এরা ভবিষ্যতে পরিবার গড়ে তোলার বিষয়ে যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে কিংবা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিবাহ বহির্ভূত সর্ম্পকে জড়িয়ে পড়ে। আইসিডিডিআরবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায়, শহরগুলোতে ৫০ শতাংশ ছেলে মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই বিবাহ বর্হিভূত কাজে জড়িয়ে পড়ে।

শুধু ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল দুনিয়াতেই নয়- রাস্তাঘাট, হাটবাজার থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই চলছে পর্নোগ্র্যাফির রমরমা বাণিজ্য।

রাজধানীর ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ থেকে নামতেই ছোট ছোট টুল টেবিলে করে পর্নো সিডি-ভিসিডি বিক্রি করা হচ্ছে। এসব বিক্রেতাদের মধ্যে বেশিরভাগ আবার শিশু বিক্রেতা।

ঔষধ বিক্রিতে পর্যন্ত অশালীন ছবি প্রদর্শনী ও অশালীন কথোপকথন এর ব্যবহার করে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। রাজধানীর ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে, বিআরটিসি কাউন্টারের পাশে, গুলিস্তান আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের পাশে ঔষধ বিক্রিতে এ বিকৃত চর্চার ঘটনা প্রায় নিয়মিত।

এ ধরনের ঘটনা রাজধানীসহ সারা দেশের অসংখ্য জায়গায় নানান কৌশলে ঘটে চলেছে।

এদিকে বন্ধ হচ্ছে না সাইবার ক্রাইম। সাইবার অপরাধী ও পর্নোসন্ত্রাসীরা কৌশলে কিংবা ফাঁদে ফেলে ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে এবং মোবাইলে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সিডি ভিসিডি বানিয়ে বিক্রি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোপন ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে এটি করা হচ্ছে। এ নিয়ে কিছু দিন বেশ শোরগোল শোনা গেলেও এ অপরাধ বন্ধ হয় নি।

অথচ পর্নোগ্র্যাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ পাশ হওয়ার পর এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

এ আইনে বলা আছে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কাটুর্ন বা লিফলেট, অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই তার সবই পনোর্গ্র্যাফি। এসব পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ বা প্রদর্শন করা যাবে না।

যারা এই আইন মানবে না তাদের ২ বছর থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড ভোগ করতে হবে।

কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় দেদারছে আইন লঙ্গন করে চলছে এক শ্রেণীর মুনাফা লোভী। চোখের সামনে পর্নো আইনের এ রকম লঙ্গন হয়ে চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অজানা কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রীয় থাকছে।

রাস্তার উপর গণউপদ্রব সৃষ্টিকারী প্রকাশ্য পর্নো সন্ত্রাসসহ সবধরণের পর্নোগ্র্যাফি কিংবা বিকৃত রুচির উপাদানে ভরা ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন বন্ধ করা শুধু একটা স্বিদ্ধান্ত আর আন্তরিকতার ব্যাপার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা, ভুক্তভোগীদের দাবিও তাই।

আমানুল্লাহ বলেন, ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এর মাধ্যমে এ সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনে প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র থাকতে হবে। নইলে এখনকার মত আটকে দুই একদিনের মাথায় বেরিয়ে চলে আসবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি পরিবার ও সামাজিকভাবে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাঠ্যবইয়ে এসর্ম্পকে সচেতন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন